দূর দিগন্তে গ্রামগুলি জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায়,
দিগন্ত চিরে লাল মাটির রাস্তা সব চলে গেছে সেদিকেই,
কালো মাছির মত ছোট দেখায় রাখাল বালক আর তার সাথে
ঘরে ফেরা গরু-মোষ-ছাগল। জঙ্গলে তখন পাখিদের কিচির মিচির।
আমি ফিরে আসছিলাম বাড়ী, নতুন গোবরে নিকানো দাওয়া,
জামবাটি ভরা মুড়ি নারকেল, আর দু-পলা সরষের তেল।
শুধু পা ছড়িয়ে খাবো বলে, টানা কুড়ি বছর পর।
গ্রামে ঢুকে দেখলাম অন্ধকার, সমস্ত গ্রামে শ্মশানের স্তব্ধতা,
নিকানো উঠান কারা খুঁড়ে দিয়ে গেছে, জামবাটি পড়ে আছে
কাঠের ঘোড়ার খুলে যাওয়া চাকার মতন,
জংগলে মাওবাদী নামে নতুন জানোয়ার এসেছে,
তাই শিকারের আয়োজন। আমি ছুটতে থাকলাম জোরে
দিগন্ত থেকে পিচ রাস্তার দিকে, শহরে যেতে হবে এক্ষুনি
আমার শিকড় সরকার খুঁড়ে দিয়ে গেছে, ঝড় ওঠার আগে
মাটি খুঁজে নিতে হবে ক্রংক্রিটের মেঝেয়। আঃ কি নিরাপদ!
নিমেষে উড়ে যায়, বিছানার চাদরে শরীর ঢেকে অবলুপ্ত প্রেমের চিতা জলে ধিকি ধিকি,
তখনো ঘামের গন্ধ তার সারা গালে, সিক্ত চুম্বনের আবেশ দুই চোখ জুড়ে,
কিন্তু কোথা প্রেম, আর তার ঝরে পড়ে থাকা করবীর সৌগন্ধ-
এর থেকে ঢের বেশী ভালো ছিল, লোক লজ্জার ভয়,
পূর্নিমার রাতে কোন পুলের সিঁড়িতে বসে থাকা, দূরে গাছের আড়ালে থাক থাক অন্ধকার।
আমি বোবা হয়ে যেতাম তোমাকে ফিরে যেতে হবে বলে।
এখন খুব কাছা কাছি, আমি নদী তুমি পাড় -
আমি ধাক্কা দিই তুমি ঝরে ঝরে পড়,
ভালো বাসা বালি হয়ে গেছে,
কখনো সখনো বালি খুঁড়ে এখন জল খাওয়া চলে-
খুব পরিস্কার কিন্তু হয়তো বিষাক্ত।
বসন্ত
ভাষা নেই আর পিপাসার্ত মুখে – এ বসন্তের তাপে সকলি শুষ্ক,
গলে যাচ্ছে চেতনারা আর অনুভূতিগুলো যে গুলো সদ্যোজাত।
তবুও বসন্তে মনকে ভালো রাখতে হয়,
গুঁজে দিতে হয় প্রস্ফূটিত গোলাপ সময়ের খোঁপায়,
হৃদয়ের বারন্দা ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার রাখতে হয়-
নাহলে নোংরা উড়বে চারিদিকে মলয় বাতাসে।
চুইংগামের মত একঘেয়ে বসন্ত, চোয়াল জুড়ে অতিচর্বনের ব্যাথা
ফেলো দেবো সে সাহস নেই, অজান্তে জুতোয় লাগবে কখন!
সাপের ছুঁচো গেলা হয়ে গলায় বসন্ত, ছেড়ে দেবো সেই উদারতা নেই।
অমার্জিত তোমার প্রকোপ বসন্ত – তোমার সঙ্গমে আমার কবিতা জন্ম নেয়।
পৃথিবীর অরন্যে তুমি আদিম বসন্ত- তুমি আসো যাও ইচ্ছা মত
আমাদের কে সহ্য করতে হয়, ভালবাসতে হয়।
#Sujesh
আমার সামনে অন্ধকার আর পেছনেও অন্ধকার। কোথায় কোন ক্ষীণ মাত্র আলোর দেখা নেই। আলমারিতে রাখা ফাইলের মধ্যে আমার ডিগ্রী গুলো রাত্রে বেলায় আলো নিভলেই বাঘ হয়ে বেরিয়ে পড়ে। আমার সারা গায়ে তাদের জিহ্বার লেহন আমি অনুভব করতে পারি। সারারাত ঘুমাতে পারি না। চোখ দুটো ঘন লাল হয়ে আসে। কি করবো? কিভাবে করবো? চাকরীর পরীক্ষা গুলো দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছি। রেজাল্টের দিন এক শূন্যতা গ্রাস করে রাখে। মনে মনে ভীষণ রাগ হয়। বিকাশের চাকরী হয়ে গেলো। পার্টি দিল আমাদের সবাইকে। জল মেশানো মদের হালকা হলুদ রংয়ে চুমুক দিতে দিতে বললো – জামাইবাবু দুলক্ষ না দিলে চাকরীটা হত না। আমার কানে গরম তেলের মত কথা গুলো ঢুকছিল তখন। টাকা আমার নেই তাই চাকরীর কথা ভেবেও লাভ নেই। টাকা না দিলে কি তবে চাকরী হয় না? তাহলে বীণার মত গরীব মেয়ে চাকরী কিভাবে পেল! বীণা কে পরে জিজ্ঞেস করেছিলাম – আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল বীণা, বান্ধবী বললে বীণার সাথে আমার সম্পর্কটা ঠিক বোঝানো যাবে না। বীণা চোখের দুকোনে দু ফোঁটা জল জমিয়ে আমাকে বলেছিল , এক নেতার সাথে তাকে রাতে শুতে হয়েছিল। যদিও ওর বরকেও ও বলে নি এই কথাটা।
বাইরে থেকে এই পৃথিবীটাকে যত সুন্দর দেখতে লাগে তত সুন্দর এই পৃথিবীটা মোটেও নয়। তাই আমার জীবনে তেতোর থেকেও তেতো হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। কিছু উপার্জন না করলে নিজেকে বড় ভিখারি ভিখারি মনে হয়। মনের সব আশা আখাঙ্খা গুলো গলা টিপে ধরে রাখতে হয়। কিন্তু তারা তাদের নখ দাঁত দিয়ে আমার হাত ক্ষত বিক্ষত করে দেয়। মামনী দেখা হলেই ফোঁস ফোঁস করে। বলে কিছু একটা করো। বাবা বলেছে একটা খুব ভালো পাত্র আছে। প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক- খুব বেশী দেনা-পাওনাও নাকি চায় না। আমি কিছু না করলে সে নাকি আর আটকিয়ে রাখতে পারবে না। মুখ বুজে থাকলেই সব শেষ। আমার বুকের ভেতরটা শুধু হু হু করে – মুখে কথা ফোটে না। চোখের সামনে ভেসে যায় কলেজের সেই সুখ মাখানো প্রেমের দৃশ্য গুলি। আমি আর মামনী, মামনী আর আমি। চুমু, বেডসিন সব আমাদের সারা এবার শুধু ক্লাইম্যাক্স।
মাঝে মাঝে ভাবি যখন কিছুতেই কিছু হল না তাহলে কি এবার রাজনীতি করবো। কিন্তু অতটা চুতিয়া আমার দ্বারা হওয়া সম্ভব নয়। আমার কিছুই নেই, খুঁটির জোর নেই, বাপের পয়সা নেই, সুখের হাওয়া নেই, আম আঁটির ভেঁপু নেই, কিন্তু যেটা আছে সেটা হল আত্ম সম্মান বোধ। গরীবের নাকি ঐ টুকুই সম্বল। রাজনীতি করতে গেলে সেটাকেও ফেলে দিতে হবে। নাহলে ঠাঁই হবে না ওই কাদার মধ্যে। আমার মধ্যে শুধু চক্রাকারে ওই কথাটাই ঘুরে বেড়াচ্ছে কদিন ধরে – কি করবো কি করবো?
কোথাও বেশ শুনেছিলাম কি করবো? কি করবো? ভাবলে কিছুই করা যায় না। তাই আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই সোজা চলে গেলাম ভজার কাছে। ভজা পড়া শোনা ছেড়েছিল অনেক আগেই। বুঝেছিল মধ্যবিত্তের কাছে শিক্ষার মূল্য কম, টাকার মূল্যই ঠিকঠাক। তাই ভজা একটা অটোরিকশা কিনে সেটাকেই ধ্যান জ্ঞান করে আজ-কাল চারটা অটোর মালিক। এবং স্ত্রী-পুত্র সহ সংসারী। যেহেতু পড়াশোনায় পেছনে তাই বন্ধুত্বের মর্যাদাটা ও রক্ষা করে। ভজা কে বলতেই ভজা রাজী হয়ে গেল। বললো –বাঁচালি ভাই, একটা ড্রাইভার একদম নতুন আমার কাছে। তুই থাকলে একটু বল ভরসা থাকে। ওই অটোটাতে ওর সাথে থাক, ড্রাইভারীটা শিখেও যাবি, লাইনটাও বুঝে যাবি। আর ও তুই থাকলে চুরি টুরি করবে না, আমি অনেকটা বাঁচবো’। কে কাকে বাঁচালো তা আমি আর ভগবানই বুঝলাম। ভজার কথা শুনে টাকা পয়সার কথা আর জিজ্ঞেস করতে পারলাম না।
ভজার অটো রিক্সার হেল্পারী করছি চার পাঁচ দিন। অনেক কিছুই নতুন নিয়ম শিখছি। গাড়ী চালিয়েছি দু চার দিন। মামনি কে কিছু বলি নি। দেখা হলে বলবো। ফোন করা বারণ আছে। তবে মামনিও ফোন করে নি এই কদিন। ভজা খুব খুশী ওর নাকি যে গাড়িটায় আমি থাকি সেল বেড়েছে। ড্রাইভার ছেলেটাও বেশ ভালো। তবে টাকা পয়সার দিকে একটু বেশী ঝোঁক। আমাকে পছন্দ – অপছন্দ কোনটাই করে না। এটা বেশ বুঝতে পারি। আমি শুধু যাত্রীদের কাছ থেকে পয়সা নি, অটো থামলে গন্তব্যস্থান গুলির নাম বলি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আর মাঝে মাঝে হেসে উঠি মনে মনে এই কাজ করবো বলেই কি কলেজে পড়েছিলাম? মুখস্থ করেছিলাম উপপাদ্য, বীজগণিতের সূত্র। আর লজ্জা আসে না। তারা আমায় ছেড়ে চলে গেছে এই শহরের অটো স্ট্যণ্ডগুলির পাশের ধূলাতে অথবা পাবলিক টয়লেটে যেখানে মোতার সময় কানে পৈতা জড়িয়ে আমার লজ্জা গুলিকে আমি ছেড়ে দিয়েছি শরীরের বর্জ্য তরলের সাথে সাথে।
আমি এখন স্বপ্ন দেখতে পাই মামনিকে নিয়ে আমার সুখের সংসার। ঘামে ভেজা আমার গেঞ্জি আছে পড়ে বিছানার পাশে। আলমারিতে রাখা ডিগ্রীর ফাইল বই পোকা কাটে গুন গুন করে- ঘুম তখন নেমে আসছে আমার দুচোখে। আমি এখন অটোর ড্রাইভার। সেই গুন গুন শব্দ যেন ভায়োলিন বাজে মৃদু স্বরে। আহা কি আনন্দ আমার ঘুম পাচ্ছে আবার। আমি ঘুমচ্ছি অনেক দিনের পরে।
মামনির ফোন আর আসে নি আমার কাছে। তবে আমার অটোতে একদিন মামনি এসেছিল একটা শিক্ষকের হাতে হাত রেখে। ভাড়া নেবার সময় মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতেই শিক্ষকের ভুরু গিয়েছিল কুঁচকে। মামনি তাড়াতাড়ি বলেছিল – তোর নাম রজতাভ না, আমাদের সাথে কলেজে পড়তি মনে আছে?
-হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব মনে আছে। আচ্ছা ভাড়া দিতে হবে না তোমাদের, যতই হোক একদিন বন্ধু ছিলে।
হ্রদয়ের সব কথা সব সময় বলা যায় না।
কিন্তু কুরে কুরে খায় তারা হ্রদয়ের অন্তরাল।
স্বাভাবিকতা থেকে সরে আসে মন
তার থাকে শুধুই ক্রন্দন।
বুকের লোমের ফাঁকে ফাঁকে
বিন্দু বিন্দু ঘামের মত লেপটে থাকে তারা-
সেই সব কথার সূত্র ধরেই আমি বেঁচে থাকি।
নিজেকে ভুলে অঘ্রানের মাঠে মাঠে ঘুরি,
তুলে রাখি কৃষকের ফেলে যাওয়া ধানের শীষের মত স্মৃতি।
যা তুমি দিয়েছিলে নদী তীরে সেই গাছের তলায় বা একসাথে
কোন এক অচেনা রিক্সায় হঠাৎ কোলে বসে।
কেউ দেয় কাঁথা-কানি, কেউ দেয় মশারী,
জনগণ আছে কম বেশী আছে ভিখারি।
একশটা দিন ধরে কাজ দিয়ে বলে কেউ,
‘বছরের বাকী দিন করে যাও ভেউ-ভেউ’।
বিধবার পেনশন সধবাও ঝেড়ে দেয়,
সরকার টাকা গাছ নেতাগণ নেড়ে নেয়।
নিজেরাই লাঠালাঠি; ফাটাফাটি মাথা ভাই
বলে সবে মাথা আছে তার নাকি মাথা নাই।
টিভি আছে, গাড়ি আছে তাও নাকি বিপিএল,
সস্তায় চাল পায়, বেচে দিয়ে কেনে তেল!
সেই তেল ঠিক ভাবে দিলে ঠিক জায়গায়,
সব পাবে হেসে খেলে সরকারী খরচায়,
চাকরী তাও পাবে দিলে পান খরচা,
পেয়ে যাবে জব-কার্ড, পেয়ে যাবে পরচা।
আর যদি বল এসে ওটা মোর অধিকার,
চান্স আছে খুব জেনো সোজা ঘাড় ধাক্কার।
তাই ছিটে ফোঁটা পেলে চেটেপুটে খেয়ে নাও,
হিসাবের ধাঁধা শুনে কেন হাঁদা হতে চাও?