27 January, 2015 0 comments

একদিন বন্ধু ছিলে (গল্প)

আমার সামনে অন্ধকার আর পেছনেও অন্ধকার। কোথায় কোন ক্ষীণ মাত্র আলোর দেখা নেই। আলমারিতে রাখা ফাইলের মধ্যে আমার ডিগ্রী গুলো রাত্রে বেলায় আলো নিভলেই বাঘ হয়ে বেরিয়ে পড়ে। আমার সারা গায়ে তাদের জিহ্বার লেহন আমি অনুভব করতে পারি। সারারাত ঘুমাতে পারি না। চোখ দুটো ঘন লাল হয়ে আসে। কি করবো? কিভাবে করবো? চাকরীর পরীক্ষা গুলো দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছি। রেজাল্টের দিন এক শূন্যতা গ্রাস করে রাখে। মনে মনে ভীষণ রাগ হয়। বিকাশের চাকরী হয়ে গেলো। পার্টি দিল আমাদের সবাইকে। জল মেশানো মদের হালকা হলুদ রংয়ে চুমুক দিতে দিতে বললো – জামাইবাবু দুলক্ষ না দিলে চাকরীটা হত না। আমার কানে গরম তেলের মত কথা গুলো ঢুকছিল তখন। টাকা আমার নেই তাই চাকরীর কথা ভেবেও লাভ নেই। টাকা না দিলে কি তবে চাকরী হয় না? তাহলে বীণার মত গরীব মেয়ে চাকরী কিভাবে পেল! বীণা কে পরে জিজ্ঞেস করেছিলাম – আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল বীণা, বান্ধবী বললে বীণার সাথে আমার সম্পর্কটা ঠিক বোঝানো যাবে না। বীণা চোখের দুকোনে দু ফোঁটা জল জমিয়ে আমাকে বলেছিল , এক নেতার সাথে তাকে রাতে শুতে হয়েছিল। যদিও ওর বরকেও ও বলে নি এই কথাটা।

বাইরে থেকে এই পৃথিবীটাকে যত সুন্দর দেখতে লাগে তত সুন্দর এই পৃথিবীটা মোটেও নয়। তাই আমার জীবনে তেতোর থেকেও তেতো হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। কিছু উপার্জন না করলে নিজেকে বড় ভিখারি ভিখারি মনে হয়। মনের সব আশা আখাঙ্খা গুলো গলা টিপে ধরে রাখতে হয়। কিন্তু তারা তাদের নখ দাঁত দিয়ে আমার হাত ক্ষত বিক্ষত করে দেয়। মামনী দেখা হলেই ফোঁস ফোঁস করে। বলে কিছু একটা করো। বাবা বলেছে একটা খুব ভালো পাত্র আছে। প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক- খুব বেশী দেনা-পাওনাও নাকি চায় না। আমি কিছু না করলে সে নাকি আর আটকিয়ে রাখতে পারবে না। মুখ বুজে থাকলেই সব শেষ। আমার বুকের ভেতরটা শুধু হু হু করে – মুখে কথা ফোটে না। চোখের সামনে ভেসে যায় কলেজের সেই সুখ মাখানো প্রেমের দৃশ্য গুলি। আমি আর মামনী, মামনী আর আমি। চুমু, বেডসিন সব আমাদের সারা এবার শুধু ক্লাইম্যাক্স।

মাঝে মাঝে ভাবি যখন কিছুতেই কিছু হল না তাহলে কি এবার রাজনীতি করবো। কিন্তু অতটা চুতিয়া আমার দ্বারা হওয়া সম্ভব নয়। আমার কিছুই নেই, খুঁটির জোর নেই, বাপের পয়সা নেই, সুখের হাওয়া নেই, আম আঁটির ভেঁপু নেই, কিন্তু যেটা আছে সেটা হল আত্ম সম্মান বোধ। গরীবের নাকি ঐ টুকুই সম্বল। রাজনীতি করতে গেলে সেটাকেও ফেলে দিতে হবে। নাহলে ঠাঁই হবে না ওই কাদার মধ্যে। আমার মধ্যে শুধু চক্রাকারে ওই কথাটাই ঘুরে বেড়াচ্ছে কদিন ধরে – কি করবো কি করবো?

কোথাও বেশ শুনেছিলাম কি করবো? কি করবো? ভাবলে কিছুই করা যায় না। তাই আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই সোজা চলে গেলাম ভজার কাছে। ভজা পড়া শোনা ছেড়েছিল অনেক আগেই। বুঝেছিল মধ্যবিত্তের কাছে শিক্ষার মূল্য কম, টাকার মূল্যই ঠিকঠাক। তাই ভজা একটা অটোরিকশা কিনে সেটাকেই ধ্যান জ্ঞান করে আজ-কাল চারটা অটোর মালিক। এবং স্ত্রী-পুত্র সহ সংসারী। যেহেতু পড়াশোনায় পেছনে তাই বন্ধুত্বের মর্যাদাটা ও রক্ষা করে। ভজা কে বলতেই ভজা রাজী হয়ে গেল। বললো –বাঁচালি ভাই, একটা ড্রাইভার একদম নতুন আমার কাছে। তুই থাকলে একটু বল ভরসা থাকে। ওই অটোটাতে ওর সাথে থাক, ড্রাইভারীটা শিখেও যাবি, লাইনটাও বুঝে যাবি। আর ও তুই থাকলে চুরি টুরি করবে না, আমি অনেকটা বাঁচবো’। কে কাকে বাঁচালো তা আমি আর ভগবানই বুঝলাম। ভজার কথা শুনে টাকা পয়সার কথা আর জিজ্ঞেস করতে পারলাম না।

ভজার অটো রিক্সার হেল্পারী করছি চার পাঁচ দিন। অনেক কিছুই নতুন নিয়ম শিখছি। গাড়ী চালিয়েছি দু চার দিন। মামনি কে কিছু বলি নি। দেখা হলে বলবো। ফোন করা বারণ আছে। তবে মামনিও ফোন করে নি এই কদিন। ভজা খুব খুশী ওর নাকি যে গাড়িটায় আমি থাকি সেল বেড়েছে। ড্রাইভার ছেলেটাও বেশ ভালো। তবে টাকা পয়সার দিকে একটু বেশী ঝোঁক। আমাকে পছন্দ – অপছন্দ কোনটাই করে না। এটা বেশ বুঝতে পারি। আমি শুধু যাত্রীদের কাছ থেকে পয়সা নি, অটো থামলে গন্তব্যস্থান গুলির নাম বলি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আর মাঝে মাঝে হেসে উঠি মনে মনে এই কাজ করবো বলেই কি কলেজে পড়েছিলাম? মুখস্থ করেছিলাম উপপাদ্য, বীজগণিতের সূত্র। আর লজ্জা আসে না। তারা আমায় ছেড়ে চলে গেছে এই শহরের অটো স্ট্যণ্ডগুলির পাশের ধূলাতে অথবা পাবলিক টয়লেটে যেখানে মোতার সময় কানে পৈতা জড়িয়ে আমার লজ্জা গুলিকে আমি ছেড়ে দিয়েছি শরীরের বর্জ্য তরলের সাথে সাথে।

আমি এখন স্বপ্ন দেখতে পাই মামনিকে নিয়ে আমার সুখের সংসার। ঘামে ভেজা আমার গেঞ্জি আছে পড়ে বিছানার পাশে। আলমারিতে রাখা ডিগ্রীর ফাইল বই পোকা কাটে গুন গুন করে- ঘুম তখন নেমে আসছে আমার দুচোখে। আমি এখন অটোর ড্রাইভার। সেই গুন গুন শব্দ যেন ভায়োলিন বাজে মৃদু স্বরে। আহা কি আনন্দ আমার ঘুম পাচ্ছে আবার। আমি ঘুমচ্ছি অনেক দিনের পরে।

মামনির ফোন আর আসে নি আমার কাছে। তবে আমার অটোতে একদিন মামনি এসেছিল একটা শিক্ষকের হাতে হাত রেখে। ভাড়া নেবার সময় মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতেই শিক্ষকের ভুরু গিয়েছিল কুঁচকে। মামনি তাড়াতাড়ি বলেছিল – তোর নাম রজতাভ না, আমাদের সাথে কলেজে পড়তি মনে আছে?

-হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব মনে আছে। আচ্ছা ভাড়া দিতে হবে না তোমাদের, যতই হোক একদিন বন্ধু ছিলে।

 
;